এক.
মাথায় একবার গল্পের প্লট তৈরি হয়ে গেলে তা পূর্ণাঙ্গভাবে লিখে শেষ করার আগ পর্যন্ত যে কী অশান্তি লাগে, তা কেবল একজন লেখকই জানে। একবার আমার ক্ষেত্রেও এমন হলো- গ্রামীণ পটভূমি নিয়ে একটি উপন্যাসের রূপরেখা তৈরি, অথচ যান্ত্রিক এ নগরে বসে কিছুতেই তা লিখতে পারছি না। পরিবেশ পাল্টাতে তাই রতনপুর যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
অনেকদিন পর আমাকে দেখে মামা-মামী বেশ খুশি হলেন। মামা তার সেই চিরচেনা ভঙ্গিতে বললেন, "কিরে ব্যাটা, এতোদিন পর আমাদের কথা মনে পড়ল?"
আমি লজ্জায় পড়ে গেলাম। ভেবে দেখলাম, ঠিকই তো, শহরের নানামুখী ব্যস্ততায় দিনদিন কেমন যেন আত্নকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছি।
পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। তখন গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি ছিল, এখন মুষলধারে। সর্ষের তেল দিয়ে মাখানো ঝালমুড়ি খেতে খেতে মামার কথা শুনছি, আবহ সঙ্গীত হিসেবে টিনের চালায় বৃষ্টির শব্দ তো রয়েছেই।
মামাতো বোনদুটোর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর মামা-মামী অনেকটাই একা হয়ে গিয়েছিলেন। আমাকে পেয়ে মামা তাই কথার ঝুড়ি নয়, রীতিমতো কথার পসরা সাজিয়ে বসেছেন। তবে দুর্ভাগ্যবশত, গল্প লেখার ক্ষেত্রে আমার যতটা স্বতঃস্ফূর্ততা, গল্প করার ক্ষেত্রে ঠিক ততোটাই ইতঃস্ততা। আমি শুধু নীরব শ্রোতার মতো মাথা নাড়িয়ে তার কথাগুলো শুনে গেলাম।
মামী রাতের খাবার নিয়ে এলেন।
অতিভোজে বরাবরই আমার অরুচি, অথচ মামা-মামীর জামাই আদরে বাধাও দিতে পারছি না। মামী পাতে মাছের মুড়ো তুলে দিয়ে বলছেন, "বাবা, খেয়ে দেখ, আমাদের পুকুরের মাছ।"
মামা মুরগির মাংস দিয়ে বলছেন, "মাটির চুলায় রান্না করা, খেয়ে দেখ্ কি স্বাদ! শহরে এসব কই পাবি।"
আমি ধীরে ধীরে খাচ্ছি দেখে মামী ভেবে বসলেন রান্না ভালো হয়নি। বারবার তাই খেদোক্তি করতে লাগলেন। আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম এই বলে যে, এত আন্তরিকতা দিয়ে যে খাবার রান্না করা হয়, এত আপ্যায়ন করে যা পরিবেশন করা হয়, তা নিয়ে কোনো আক্ষেপ থাকতে পারে না।
দুই.
বর্ষাস্নাত রাতের পর আলো ঝলমলে সোনালী সকাল।
আমি কাগজ-কলম নিয়ে বারান্দায় বসেছি। কখনো দু-এক লাইন লিখছি, কখনো আশেপাশে চোখ বুলাচ্ছি। মুরগিগুলো উঠোনে ছুটোছুটি করছে, মোরগটা নিজের শৌর্য প্রদর্শনের জন্য শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে বাগ্ দিয়ে যাচ্ছে। হাঁসগুলো বোধহয় এতোক্ষণে পুকুরে নেমে গেছে। গোয়ালঘরে বাছুরটার তিড়িং-বিড়িং লাফানোর কারণ কী? মা-কে কাছে পাওয়ার উচ্ছ্বাস?
বাড়ির চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আম-কাঁঠাল-পেয়ারা গাছগুলো থেকে পাখির কলতান ভেসে আসছে। রান্নাঘরে ফুলির মা নিশ্চয়ই মশলা বাটছে, শিলপাটার আওয়াজ হচ্ছে। ঘরোয়া কাজে এই মহিলাই আজকাল মামীকে সাহায্য করে। মামীও রান্নাঘরেই।
মামা বাইরে কোথাও ছিলেন, ফিরে এসে আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, "কিরে মন্টু, উঠে গেছিস? নাস্তা করেছিস?"
আমি বললাম, "হু", তারপর জানতে চাইলাম, "তুমি কোথায় গিয়েছিলে?"
মামা বললেন, "আমাদের গ্রামের জুলহাসের ছেলেটা, বয়স চার-পাঁচের মতো হবে, আজ এক নতুন কান্ড করে বসেছে। পূর্বদিকে যে ঘন বাঁশঝাড়টা আছে তার অনেক ভেতরে চলে গিয়েছিল। ছেলেটা তো কখনো কথা বলে না, লোকজন অনেক খোঁজাখুঁজি করে তারপর বের করেছে।"
ফুলির মা মসলা-ধোয়া পানি বাইরে ফেলতে বের হয়েছিল, মামার কথার সূত্র ধরে বলল, "দেখছেন মাস্টর সাব, তখন কইছিলাম না, এই পোলা মানুষ না, দেও, অহন দেখতাছেন তো? হেইদিন ফুলি কইতাছিল ওরে নাকি আমাবস্যার রাইতে কবরস্থানে যাইতে দেখছে!"
আমার এবার কৌতূহল হলো, মামার কাছে বিস্তারিত শুনতে চাইলাম।
মামা বলতে লাগলেন, "সোহেলের জন্ম হয়েছিল পুর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময়। সূর্যগ্রহণ নিয়ে গ্রামবাসীর মধ্যে নানারকম ধারণা প্রচলিত আছে। গ্রহণের সময় গর্ভবতী নারীরা কিছু খেলে অনাগত সন্তানের ক্ষতি হবে, কাটাকুটি করলে কানকাটা কিংবা ঠোঁটকাটা শিশুর জন্ম হবে- এসব বিশ্বাস করা হয় এখানে। তাই স্বাভাবিকভাবেই সোহেলের জন্মের পর অনেক হইচই হলো, নানাজন নানা কথা বলতে লাগল। শিক্ষিত সমাজ তাদের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করল, সূর্যগ্রহণের সাথে অশুভ কিছুর কোনো সংযোগ নেই। কিন্তু বহুদিনের লালিত বিশ্বাস তো আর সহজেই মন থেকে মুছে ফেলা যায় না, ওদেরটাও যায়নি। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার সামনে সেদিন তারা চুপ থেকেছিল বটে, কিন্তু সোহেল বড় হবার সাথে সাথে ওর আচরণে যখন অস্বাভাবিকতা দেখা দিতে লাগল, তখন ওরা আবার আগের মতোই ওকে অশুভ বলতে শুরু করল।"
আমি জানতে চাইলাম, "ওর অস্বাভাবিকতাগুলো কী রকম?"
মামা বললেন, "ছেলাটা কারও সাথেই কথা বলে না, ডাকলে সাড়া দেয় না। প্রথমে মনে করা হয়েছিল ও শুনতে পায় না, কিন্তু কলহ লাগলে কিংবা ক্রমাগত শব্দ হলে ও জোড়ে চিৎকার শুরু করে, তখন থামানো যায় না। আবার পরিবারের কাউকেই ও চিনে না, মা আদর করতে চাইলে দূরে সরিয়ে দেয়। সবচেয়ে রহস্যময় ব্যাপার হলো, কিছুদিন আগে আগুন লেগে ওর ডানহাতের অনেকখানি পুড়ে যায়, অন্য শিশু হলে চেঁচিয়ে সারা গ্রাম এক করে ফেলত, অথচ ও এখন পর্যন্ত নির্বিকার!"
ছেলেটির জন্য আমার খুব মায়া লাগছিল। মামাকে জিজ্ঞস করলাম, "ওকে স্বাভাবিক করে তুলতে তোমরা কিছু করছ না কেন?"
মামা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, "অস্বাভাবিকতার কারণ জানলে তো স্বাভাবিক করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ওর অস্বাভাবিকতাগুলো যে ব্যাখ্যাহীন!"
তিন.
বিকেলের দিকে আমি একবার সোহেলদের বাসায় গেলাম। জানতে পারলাম, এখন থেকে ওকে বেঁধে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওর বাবা, গঞ্জে গিয়েছে শেকল আনতে। ওর অসহায় মা ছেলের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। সোহেলের মুখটা অভিব্যাক্তিহীন হলেও মায়াবী। এমন একটা নিষ্পাপ শিশুকে তারা কীভাবে অশুভ মনে করছে, আমি তা-ই ভেবে পাচ্ছি না!
কেমন যেন অশান্তি লাগছিল। ফিরে এসে কাগজ-কলম নিয়ে আবারও বসলাম বটে, কিন্তু কিছুই গুছিয়ে লিখতে পারলাম না। বারবার চোখের সামনে সোহেলের মুখখানা ভাসছিল, কানে বাজছিল ওর মায়ের কান্নাজড়িত প্রশ্নটি, "আমার পোলা কি কহনোই ভালা হইব না?"
আমি কোনো জবাব খুঁজে পাচ্ছিলাম না!
রাতে সিদ্ধান্ত নিলাম, ওকে ঢাকায় নিয়ে যাব। অন্তত একটি চেষ্টতো আমি করতে পারি ওকে সুস্থ করে তোলার। জানালার পাশে একটি জোনাকির আলো জ্বলছিল আর নিভছিল, একইভাবে সোহেলকে নিয়ে আমার মনে আশার আলো জাগছিল আবার অজানা আশঙ্কায় ডুবেও যাচ্ছিল।
চার.
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গল একটা কোলাহল শুনে। বিছানা ছেড়ে বাইরে বের হতেই মামীর কাছে যা শুনলাম, তা আমি কল্পনাও করিনি। সোহেলকে নিয়ে ওর মা আত্নহত্যা করেছে। ছেলেকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখার কষ্ট সে সহ্য করতে পারেনি, তাই প্রথমে বটি দিয়ে ছেলের গলা কেটেছে, তারপর নিজেও একইভাবে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়ে সমস্ত রতনপুরবাসীকে যন্ত্রণামুক্ত করে গেছে।
আমার গা শিউরে উঠে। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। ভাবি, সমাজের কতটা অবহেলা পেলে একটা মা এমন কঠিন পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়! স্বাভাবিকের বাইরে কেন আমরা কোনো ব্যতিক্রমকে মেনে নিতে পারি না? কেনো বুঝতে চাই না যে, আমাদের জানার পরিধির বাইরেও অনেক অজানা বিষয় থাকতে পারে? কেনো?
পুনঃশ্চ: কিছুদিন আগে অটিজম নিয়ে একটি প্রতিবেদন পড়ছিলাম। সেখানে বলা হয়েছে, অটিজম হচ্ছে শিশুদের মনোবিকাশগত জটিলতা। অটিস্টিক শিশুদের বৈশিষ্টগুলোও তুলে ধরা হয়েছিল সে প্রতিবেদনে। আশ্চর্যজনকভাবে বৈশিষ্ট্যগুলো সোহেলের আচরণের সাথে অবিকল মিলে যাচ্ছিল!